بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمَنِ الرَّحِيم

Mijanur Rahman 11.09.2025

বর্তমান প্রেক্ষিতে একজন আলেমের দায়িত্ব ও কর্তব্য

এনামুল হক রায়পুরী


আলেমের দায়িত্ব ও কর্তব্য

এ বিশ্বচরাচর সৃষ্টির পেছনে আল্লাহ তায়ালার রয়েছে মহাপরিকল্পনা ও মহা হিকমত। আকাশের নিলিমা, ভূমির সবুজাভ ও শ্যামলতা, সমুদ্রের গভীরতা, আকাশের দীপ্তিমান নক্ষত্ররাজি, পাহাড় পর্বতরাজি ও বায়ুমন্ডল এবং শূণ্যের সবকিছুই তাঁর সৃষ্টি। তাঁর এ সকল সৃষ্টির মধ্যে সেরা এবং শ্রেষ্ঠ ও আদুরে সৃষ্টি হচ্ছে মানুষ। এ সবই তাঁর মহা পরিকল্পনার অংশ। সৃষ্টিজগত নিয়ে তাঁর পরিবকল্পনা হলো, সৃষ্টি জগতের মাঝে তাঁর বড়ত্ব ও মহানত্বের বহিঃপ্রকাশ।

তাই তিনি তাঁর সর্বাপেক্ষা সেরা সৃষ্টির প্রতি নির্দেশ দিয়েছেন তাঁর ইবাদত ও আনুগত্যের। আর সমগ্র সৃষ্টিজগতকে নিয়োজিত রেখেছেন সে মানবের কল্যাণে। আর মানবজাতিকে তাঁর ইবাদত ও আনুগত্যের জন্য প্রদান করেছেন গাইড লাইন তথা দিকনির্দেশনা। যেটিকে সার্বজনীনভাবে শরীয়ত বলে আখ্যায়িত করা হয়। আর সে শরীয়ত তথা গাইড লাইন মানব জাতির নিকট পৌঁছে দেয়ার জন্য মাধ্যম তথা সেতুবন্ধন হিসাবে তিনি মানব সৃষ্টির শুরু লগ্ন থেকেই প্রেরণ করেছেন তাঁর কিছু নির্বাচিত ও মনোনীত বান্দাদেরকে। যাঁরা ছিলেন নবী ও রসূল। তাই তো প্রথম মানুষই হলেন প্রথম নবী।

একটি শিশু জন্মের পর থেকে ক্রমেই বৃদ্ধি পেতে থাকে। ফলে ক্রমেই তার পোশাকের আকারে পরিবর্তন ঘটতে থাকে। দুই বছর বয়সের পোশাক পাঁচ বছর বয়সে বা পাঁচ বছর বয়সের পোশাক দশ বছর বয়সে তার শরীরে ফিট হয় না। কিন্তু একটা পর্যায়ে যখন দৈহিক বর্ধন একটি স্থিতিশীল পর্যায়ে উপনীত হয় তখন আর পোশাকের আকারে পরিবর্তন করতে হয় না। বরং প্রমাণ সাইজ পোশাকই যথেষ্ট হয়। তাই ত্রিশ বছর বয়সের পোশাক চল্লিশ বছর বয়সেও তার শরীরে ফিট হয়।

তেমনিভাবে মানব জাতির সৃষ্টির শুরু লগ্নে আল্লাহ তায়ালা বান্দাকে শরীয়ত নামক যে গাইড লাইন প্রদান করেছেন তা ছিলো শিশুসম। ক্রমেই তাতে বৃদ্ধি সাধিত হয়েছে, বিভিন্ন প্রকার পরিবর্তন সাধিত হয়েছে। সে সকল পরিবর্তনগুলোর সাথে সকল যুগে আল্লাহর বান্দাদেরকে পরিচিত করার জন্য তিনি নবূওয়তের ধারা অব্যাহত রেখেছিলেন। সে পরিবর্তন ধারায় শিশু শরীয়ত স্থিতিশীল পর্যায়ে উপনীত হয়েছে আমাদের নবী সর্বশেষ নবী হযরত মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মাধ্যমে।

অতএব এখন আর শরীয়তের বিধানে পরিবর্তনের প্রয়োজন পড়বে না। বরং কিয়ামত পর্যন্ত এ শরীয়তই যথেষ্ট। ফলে নবী প্রেরণেরও আর প্রয়োজন নেই। কিন্তু সেই প্রমাণ সাইজ পোশাক তৈরীর জন্যও যেমনিভাবে একজন কারিগরের প্রয়োজন পড়ে তেমনিভাবে শরীয়তের বিধানগুলো স্থিতিশীল পর্যায়ে উপনীত হওয়ার পরও তার সাথে আল্লাহর বান্দাদেরকে পরিচিত করিয়ে দেয়ার জন্য একদল ব্যক্তির প্রয়োজন। সে দলটি কারা? সে প্রসঙ্গে নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ঘোষণা করেছেন, العلماء ورثة الأنبياء إن الأنبياء لم يورثوا دينارا ولا درهما ولكن ورثوا العلم فمن أخذه أخذ بحظ وافر-উলামাগণ আম্বিয়ায়ে কেরাম আ.-এর উত্তরাধিকারী। আর আম্বিয়ায়ে কেরাম তাঁদেরকে দিরহাম ও দীনারের উত্তরাধিকারী বানাননি। বরং ইলমের উত্তরাধিকারী বানিয়েছেন। সুতরাং যে তা গ্রহণ করলো, সে প্রাচুর্যময় অংশ গ্রহণ করলো। (তিরমিযী)

অতএব, সে-ই আলেম যে আম্বিয়ায়ে কেরামের ইলমের ওয়ারাছাত তথা উত্তরাধিকারিত্ব গ্রহণ করেছে। সুতরাং একজন আলেমের প্রথম ও প্রধান দায়িত্ব হলো, রসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ইলমকে ধারণ করা। তাঁর ইলমের উৎস ছিলো ওহী। তিনি কোন বিষয় জানার প্রয়োজন হলে হযরত জিবরাঈল আমীনের জন্য অপেক্ষা করতেন। এজন্য বহু ক্ষেত্রে দেখা গেছে তিনি আকাশের পানে তাকিয়ে জিবরাঈল আ.-এর আগমনের অপেক্ষা করছেন। অর্থাৎ তিনি কোন কিছুই অনুমান নির্ভর করে বলেননি। আল্লাহ তায়ালাও সেই সনদ প্রদান করেছেন। وَمَا يَنْطِقُ عَنِ الْهَوَى ۝ إِنْ هُوَ إِلا وَحْيٌ يُوحَى ۝-এবং প্রবৃত্তির তাড়নায় কথা বলেন না। কোরআন ওহী, যা প্রত্যাদেশ হয়। (নাজম:৩-৪)

অতএব একজন আলেমকে অবশ্যই মুহাক্কিক হতে হবে। তার কোন বিষয়ই অনুমান নির্ভর হবে না। এজন্য একজন আলেমকে যে কোন বিষয়ে অত্যন্ত গভীরভাবে অধ্যয়ন করতে হবে। কোন বিষয়ই বাহ্যিক দৃষ্টিতে অধ্যয়ন করা উচিত নয়। কারণ রসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের যুগে সাহাবায়ে কেরাম যে কোন সমস্যার সম্মুখীন হলে তার সমাধানের জন্য তাঁর দ্বারস্থ হতেন। তিনি ওহীর মাধ্যমে সে সমস্যার সমাধান প্রদান করতেন। তেমনিভাবে প্রত্যেক যুগের উম্মাহর সদস্যগণ তাদের যে কোন সমস্যার সমাধানের জন্য ওয়ারিছে নবী উলামায়ে কেরামের দারস্থ হয়ে থাকে। তাদেরকেও উম্মাহর সে সকল সমস্যার সমাধান দিতে হবে।

অতএব একজন আলেমকে অবশ্যই যুগ সমস্যা সম্পর্কে অবগতি লাভ করতে হবে এবং কোরআন-সুন্নাহর গভীর অধ্যয়নের মাধ্যমে তার সমাধান সম্পর্কে অবগতি লাভ করতে হবে। মৌলিকভাবে একজন আলেমের দায়িত্ব ও কর্তব্য কী? সে প্রসঙ্গে কোরআন মজীদের ভাষ্য হলো, هُوَ الَّذِي بَعَثَ فِي الْأُمِّيِّينَ رَسُولًا مِنْهُمْ يَتْلُو عَلَيْهِمْ آَيَاتِهِ وَيُزَكِّيهِمْ وَيُعَلِّمُهُمُ الْكِتَابَ وَالْحِكْمَةَ وَإِنْ كَانُوا مِنْ قَبْلُ لَفِي ضَلالٍ مُبِينٍ۝ তিনিই নিরক্ষরদের মধ্য থেকে একজন রসূল প্রেরণ করেছেন, যিনি তাদের কাছে পাঠ করেন তার আয়াতসমূহ, তাদেরকে পবিত্র করেন এবং শিক্ষা দেন কিতাব ও হিকমত। ইতিপূর্বে তারা ছিল ঘোর পথভ্রষ্টতায় লিপ্ত। (জুম‘আ:২)

উক্ত আয়াতে আল্লাহ তায়ালা রসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে এ ধরায় যে চারটি মৌলিক দায়িত্ব দিয়ে প্রেরণ করেছেন সেগুলো তুলে ধরেছেন। সেগুলো হলো,

  1. এক. يَتْلُو عَلَيْهِمْ آَيَاتِهِ- যিনি তাদের কাছে পাঠ করেন তার আয়াতসমূহ।
  2. দুই. وَيُزَكِّيهِمْ – তাদেরকে পবিত্র করেন।
  3. তিন. وَيُعَلِّمُهُمُ الْكِتَابَ -এবং শিক্ষা দেন কিতাব।
  4. চার. والْحِكْمَةَ -এবং শিক্ষা দেন কিতাব হেকমত।
সুতরাং ওয়ারিছে নবী হিসাবে এগুলোই একজন আলেমের দায়িত্ব ও কর্তব্য। কার্যক্ষেত্রে এ চারটি মৌলিক দায়িত্বই বিভিন্ন শাখা-উপশাখায় বিভক্ত।

অতএব মুবাল্লিগ, মু‘আল্লিম, মুযাক্কী হিসাবে একজন আলেমের ভিন্ন ভিন্ন দায়িত্ব ও কর্তব্য রয়েছে। মুবাল্লিগ হিসাবে একজন আলেমের দায়িত্ব মুবাল্লিগ হিসাবে একজন আলেমের মধ্যে কতগুলো গুণাবলী ও বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান থাকা অপরিহার্য।

এক. তাফাক্কুহ ফিদ দীন (تفقه في الدين) অর্থাৎ দীন সম্পর্কে গভীর পান্ডিত্য। একজন আলেমকে মুবাল্লিগ হিসাবে অবশ্যই দীনের বিধিবিধান ইত্যাদি সম্পর্কে গভীর ও সঠিক জ্ঞানের অধিকারী হতে হবে। কারণ নিজে ইসলামের ছহীহ মানহাজ সম্পর্কে অবগত না হলে তার দাওয়াত ইসলামের ক্ষতি বৈ উপকার করবে না। যেমন— সৎ কাজে আদেশ ও অসৎ কাজে নিষেধ করতে হলে অবশ্যই সেগুলোর ক্ষেত্র এবং পদ্ধতি সম্পর্কে ইসলামের সঠিক নির্দেশনা জানা থাকতে হবে।

দুই. ইখলাছ (الاخلاص) তথা নিষ্ঠা। কারণ ইখলাছ তথা নিষ্ঠা ও নিয়তের পরিশুদ্ধতার দ্বারাই আমলের মান নির্ণিত হয়। ক্ষুদ্র আমলও ইখলাছপূর্ণ হলে তা অনেক বেশী মর্যাদাকর হয় এবং তার প্রভাব হয় কল্পনাতীত। পক্ষান্তরে ইখলাছহীন অনেক বড় আমলও প্রভাবে হয় শূন্য। আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন, ۝ فَمَن كَانَ يَرْجُو لِقَاء رَبِّهِ فَلْيَعْمَلْ عَمَلًا صَالِحًا وَلَا يُشْرِكْ بِعِبَادَةِ رَبِّهِ أَحَدًا- অতএব, যে ব্যক্তি তার পালনকর্তার সাক্ষাত কামনা করে, সে যেন, সৎকর্ম সম্পাদন করে এবং তার পালনকর্তার এবাদতে কাউকে শরীক না করে। (কাহফ:১১০)

তিন. আল্লাহর প্রতি তাওয়াক্কুল (التوكّل على الله تعالى)। একজন আলেমকে একজন মুবাল্লিগ হিসাবে অবশ্যই আল্লাহ তায়ালার উপর তাওয়াক্কুলের গুণ অর্জন করতে হবে। তাওয়াক্কুলের অর্থ হলো, যে কোন কর্মসম্পাদনে সমকালীন যাবতীয় উপকরণ গ্রহণ করে তা হতে দৃষ্টি সরিয়ে আল্লাহ তায়ালার সত্তার প্রতি দৃষ্টি নিবদ্ধ করা এবং সত্যের ব্যাপারে কোন ক্ষমতাসীনের ক্ষমতা বা নিন্দুকের নিন্দার পরোয়া না করা। বরং এরূপ বিশ্বাস ও আস্থা অন্তরে লালন করা যে, আল্লাহ তায়ালা বান্দার যাবতীয় প্রয়োজন সম্পর্কে অবগত। তিনি বান্দার যাবতীয় প্রয়োজনে সাড়া দেন এবং প্রয়োজন পূরণে সক্ষম, তিনি কৃপণ নন বরং বান্দার প্রতি দয়ালু।

চার. বীরত্ব ও সাহসিকতা। একজন আলেমকে একজন মুবাল্লিগ হিসাবে অবশ্যই সাহসী ও নির্ভিক হতে হবে। কারণ বীরত্ব ও সাহসিকতা ছাড়া একজন মুবাল্লিগের পক্ষে ইসলামের দাওয়াতকে যাবতীয় বাধা-বিপত্তি উপেক্ষা করে সর্বত্র পৌঁছানো কিছুতেই সম্ভব হবে না।

পাঁচ. পরিবেশ পরিস্থিতি সম্পর্কে অবগতি লাভ করা। একজন আলেমকে মুবাল্লিগ হিসাবে অবশ্যই পরিবেশ পরিস্থিতি সম্পর্কে অবগতি লাভ করতে হবে। কারণ পরিবেশ পরিস্থিতি সম্পর্কে অবগতি লাভ না করলে তার দাওয়াত কার্যকর ও প্রভাবক হবে না। বরং অনেক ক্ষেত্রে বিপরীত ফল বয়ে আনতে পারে।

ছয়. উদারতা। একজন আলেমকে একজন মুবাল্লিগ হিসাবে অবশ্যই উদার হৃদয়ের অধিকারী হতে হবে। কারণ ইসলাম প্রচারে তাকে বিভিন্ন শ্রেণী ও বৈশিষ্ট্যের মানুষের মুখোমুখি হতে হবে, অনুকূল-প্রতিকূল বিভিন্ন পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হবে। তাই হযরত মূসা আ. আল্লাহ তায়ালার নিকট এরূপ দোয়া করেছিলেন। قَالَ رَبِّ اشْرَحْ لِي صَدْرِي۝وَيَسِّرْ لِي أَمْرِي۝ وَاحْلُلْ عُقْدَةً مِّن لِّسَانِي۝يَفْقَهُوا قَوْلِي۝ মূসা বললেন: হে আমার পালনকর্তা আমার বক্ষ প্রশস্ত করে দিন। এবং আমার কাজ সহজ করে দিন। এবং আমার জিহবা থেকে জড়তা দূর করে দিন। যাতে তারা আমার কথা বুঝতে পারে।

সাত. ধৈর্য ও সহনশীলতা। একজন আলেমকে অবশ্যই একজন মুবাল্লিগ হিসাবে ধৈর্যশীল, সহনশীল ও পরমতসহিষ্ণু হতে হবে। তাহলে তার পক্ষে ইসলামের দাওয়াতের বিভিন্ন পর্যায় অতিক্রম করে অভিষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছা সম্ভব হবে। আল্লাহ তায়ালা আম্বিয়ায়ে কেরামের এ বিশেষ বৈশিষ্ট্য উল্লেখ করে ইরশাদ করেন, فَاصْبِرْ كَمَا صَبَرَ أُوْلُوا الْعَزْمِ مِنَ الرُّسُلِ- অতএব, আপনি সবর করুন, যেমন উচ্চ সাহসী পয়গম্বরগণ সবর করেছেন (আহকাফ:৩৫)

আট. সত্যবাদিতা। একজন আলেমকে একজন দায়ী ও মুবাল্লিগ হিসাবে অবশ্যই সত্যবাদিতার গুণ আত্মস্থ করতে হবে। বক্তব্যে ও কর্মে সর্বক্ষেত্রেই তাকে সত্যবাদিতার পরীক্ষায় সর্বোচ্চ মানদণ্ডে উত্তীর্ণ হতে হবে। তার কর্ম হতে হবে বক্তব্যের প্রতিচ্ছবি। তাহলেই তার দাওয়াত হবে কার্যকর ও প্রভাবক।

নয়. কোমলতা। একজন আলেমকে একজন দায়ী ও মুবাল্লিগ হিসাবে অবশ্যই কোমল ভাষা ও কোমল আচরণের অধিকারী হতে হবে। আল্লাহ তায়ালা তাঁর হাবীব সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের যাদুকরী প্রভাব সম্পর্কে ইরশাদ করেন, فَبِمَا رَحْمَةٍ مِنَ اللَّهِ لِنْتَ لَهُمْ وَلَوْ كُنْتَ فَظًّا غَلِيظَ الْقَلْبِ لانْفَضُّوا مِنْ حَوْلِكَ فَاعْفُ عَنْهُمْ وَاسْتَغْفِرْ لَهُمْ-আল্লাহর রহমতে আপনি তাদের জন্য কোমল হৃদয় হয়েছেন পক্ষান্তরে আপনি যদি রাগ ও কঠিন হৃদয় হতেন তাহলে তারা আপনার কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যেতো। কাজেই আপনি তাদের ক্ষমা করে দিন এবং তাদের জন্য মাগফেরাত কামনা করুন। (আলে-ইমরান:১৫৯)

দশ. বিনয় ও নম্রতা। একজন আলেমকে একজন মুবাল্লিগ হিসাবে অবশ্যই বিনয়ী ও নম্র হতে হবে। তাহলেই জনসাধারণ তাকে আপন হিসাবে বরণ করে নেবে এবং তার দাওয়াত কবুল করবে।

মুআল্লিম হিসাবে একজন আলেমের দায়িত্ব উম্মাহর প্রতিটি সদস্যের অজ্ঞতা নামক ব্যাধির নিরাময়ে ওয়ারিছে নবী হিসাবে একজন আলেমের মধ্যে থাকবে সেই ব্যাকুলতা যা ছিলো নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মধ্যে। উম্মাহর প্রতিটি সদস্যের মধ্যে শরীয়তের বিধি-বিধানকে ছহীহরূপে পৌঁছে দেয়ার দায়িত্ববোধ সর্বদা জাগরুক থাকবে একজন আলেমের মধ্যে। ফলে যে কারো মধ্যে শরীয়তের কোন বিধানের লঙ্ঘন বা ভুল আমল দেখতে পেলে অবশ্যই তা শুধরে দেয়া একজন আলেমের অন্যতম দায়িত্ব।

সর্বোপরি শরীয়তের বিধানগুলোর ছহীহ ব্যাখ্যা উপস্থাপন, তার সংকলন, প্রচার ইত্যাদি মু‘আল্লিম হিসাবে একজন আলেমের দায়িত্ব। সে দায়িত্ব পালনে কিরূপ হবে তার অবস্থান সে প্রসঙ্গে রসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সম্পর্কে একজন সাহাবীর উক্তিই যথেষ্ট।

عَنْ مُعَاوِيَةَ بْنِ الْحَكَمِ السُّلَمِيِّ، قَالَ: بَيْنَا أَنَا أُصَلِّي مَعَ رَسُولِ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ، إِذْ عَطَسَ رَجُلٌ مِنَ الْقَوْمِ، فَقُلْتُ: يَرْحَمُكَ اللهُ فَرَمَانِي الْقَوْمُ بِأَبْصَارِهِمْ، فَقُلْتُ: وَاثُكْلَ أُمِّيَاهْ، مَا شَأْنُكُمْ؟ تَنْظُرُونَ إِلَيَّ، فَجَعَلُوا يَضْرِبُونَ بِأَيْدِيهِمْ عَلَى أَفْخَاذِهِمْ، فَلَمَّا رَأَيْتُهُمْ يُصَمِّتُونَنِي لَكِنِّي سَكَتُّ، فَلَمَّا صَلَّى رَسُولِ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ، فَبِأَبِي هُوَ وَأُمِّي، مَا رَأَيْتُ مُعَلِّمًا قَبْلَهُ وَلَا بَعْدَهُ أَحْسَنَ تَعْلِيمًا مِنْهُ، فَوَاللهِ، مَا كَهَرَنِي وَلَا ضَرَبَنِي وَلَا شَتَمَنِي، قَالَ: إِنَّ هَذِهِ الصَّلَاةَ لَا يَصْلُحُ فِيهَا شَيْءٌ مِنْ كَلَامِ النَّاسِ، إِنَّمَا هُوَ التَّسْبِيحُ وَالتَّكْبِيرُ وَقِرَاءَةُ الْقُرْآنِ।

হযরত মু‘আবিয়া ইবনুল হাকাম আস-সুলামী রা. হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, একদা আমি রসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাথে নামায আদায় করছিলাম। হঠাৎ এক ব্যক্তি হাঁচি দিলো। আমি জবাবে يَرْحَمُكَ اللهُ বললাম। তখন উপস্থিত সকলে আমাকে দৃষ্টিবানে জর্জরিত করছিলো। আমি বিরক্ত হয়ে বললাম, কী হলো তোমাদের? কেন তোমরা এভাবে আমার প্রতি দৃষ্টিনিবদ্ধ করছো? তখন তারা নিজেদের হাত দ্বারা উরুতে আঘাত করতে লাগলো। আমি যখন তাদেরকে দেখলাম যে, তারা আমাকে চুপ করাতে চাচ্ছে, আমি বিরক্তি বোধ করলাম তবুও চুপ হয়ে গেলাম। রসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নামায সম্পন্ন করে আমাকে বললেন, নামায দুনিয়াবী কথা বলার ক্ষেত্র নয়, এ তো হলো শুধু তাসবীহ, তাকবীর ও কোরআন তিলাওয়াতের ক্ষেত্র। আমার পিতা-মাতা রসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রতি উৎসর্গিত, আমি তাঁর পূর্বে বা পরে তিনি অপেক্ষা উত্তম শিক্ষাদানকারী মুআল্লিম (শিক্ষক) দেখিনি। আল্লাহর কসম তিনি না আমাকে ধমক দিয়েছেন, না প্রহার করেছেন, না গালি দিয়েছেন। (মুসলিম)

মুযাক্কী হিসাবে একজন আলেমের দায়িত্ব উম্মতের প্রতিটি সদস্য যাতে তাদের চিরশত্রু শয়তানের খপ্পর থেকে মুক্ত হয়ে তাদের আসল নিবাস জান্নাত লাভ করতে পারে সে জন্য রসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আلাইহি ওয়া সাল্লাম যেরূপ ব্যাকুল ছিলেন ওয়ারিছে নবী হিসাবে একজন আলেমের মধ্যেও সেরূপ ব্যাকুলতা থাকা অপরিহার্য। সূরা ‘আবাসা’ নাযিলের প্রেক্ষাপটই এজন্য যথেষ্ট। এছাড়াও আল্লাহ তায়ালা তাঁর এ ব্যাকুলতায় সান্ত্বনা প্রদান কল্পে ইরশাদ করেন, فَلَعَلَّكَ بَاخِعٌ نَفْسَكَ عَلَى آَثَارِهِمْ إِنْ لَمْ يُؤْمِنُوا بِهَذَا الْحَدِيثِ أَسَفًا۝- যদি তারা নির্বুদ্ধিতা হেতু এই বিষয়ের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন না করে, তবে তাদের পশ্চাতে সম্ভবত: আপনি পরিতাপ করতে করতে নিজের প্রাণ নিপাত করবেন। (কাহফ:৬)

উম্মতের অবস্থায় তাঁর অস্থিরতা দূরীকরণে আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন, ۝ لَسْتَ عَلَيْهِمْ بِمُسَيْطِرٍ -আপনি তাদের শাসক নন, (গাশিয়া:২২) বর্তমান পরিস্থিতিতে একজন আলেমের জন্য আত্মপরিচয় সচেতনতা অপরিহার্য কর্তব্য। কারণ আত্মপরিচয় সচেতন হলেই একজন আলেমের মধ্যে ইলমী ও ঈমানী গায়রত তথা আত্মমর্যাদাবোধ জাগরুক থাকবে, যা বর্তমানে বিরল বস্তুতে পরিণত হচ্ছে।

ইলমী-ঈমানী গায়রত সম্পন্ন একজন আলেমের পক্ষেই সম্ভব হীন পার্থিব স্বার্থকে পায়েদলে সত্য প্রকাশ করা ও সত্যের পথে অটল ও অবিচল থাকা। অন্যথায় পার্থিব হীন স্বার্থে নিজেকে খুব স্বল্পমূল্যে বিক্রি করে লাঞ্ছিত অপমানিত হয়েও তার মধ্যে আত্মপোলব্ধি জাগ্রত হবে না, যা বর্তমান যুগে বিশেষত বাংলাদেশের আলেম সমাজের জন্য অত্যন্ত দুঃখজনক ও কষ্টকর একটি বাস্তবতা।

এ আত্মমর্যাদাবোধ নামক অমূল্য রত্নই পারে একজন আলেমকে পার্থিব স্বার্থে অন্ধত্ব, আত্মপুজা, ঈমান ও ইলমী শানকে জলাঞ্জলী দিয়ে কালবুদ দুনিয়ায় (كلب الدنيا) পরিণত হওয়া থেকে রক্ষা করতে। তেমনিভাবে বর্তমান পরিস্থিতিতে একজন আলেমকে অবশ্যই জাতীয় ও আন্তর্জাতিক অবস্থা ও পরিস্থিতি সম্পর্কে সম্যক অবগতি লাভ করতে হবে। কারণ বর্তমান বিশ্ব হচ্ছে একটি গ্লোবাল ভিলেজতুল্য।

সুতরাং বিশ্বের প্রতিটি দেশ ও জনগোষ্ঠী অপর দেশ ও জনগোষ্ঠী সম্পর্কে সম্পূর্ণরূপে অবগত। ফলে প্রত্যেকে একে অপরের সবলতা ও দুর্বলতা সম্পর্কে অবগত। তাই সবল দেশগুলো দুর্বল দেশগুলোর উপর নিজেদের ধর্ম, সংস্কৃতি চাপিয়ে দিয়ে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়। আর সে সব দেশে তারা তৈরী করে তাদের ক্রীড়নক ও দোসর।

অতএব জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সকল ষড়যন্ত্র সম্পর্কে একজন আলেমকে অবশ্যই সচেতন হতে হবে। তাহলেই সম্ভব হবে ইসলাম, দেশ ও জাতিকে তাদের ষড়যন্ত্র থেকে রক্ষা করা। মোটকথা একজন আলেমকে আত্মপরিচয় লাভ করে, হীনমন্যতার শিকার না হয়ে ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র সর্বক্ষেত্রে নিজের দায়িত্ব ও কর্তব্য সম্পর্কে সচেতন হতে হবে এবং সুচারুরূপে নিজের দায়িত্ব আঞ্জাম দিতে হবে। আল্লাহ তায়ালা আমাদের তাওফীক দান করুন। আমীন॥