بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمَنِ الرَّحِيم

Mijanur Rahman 11.09.2025

ধর্মহীনতার নতুন সংস্করণ ধর্মনিরপেক্ষতা

ধর্মহীনতার নতুন সংস্করণ ধর্মনিরপেক্ষতা

মানব প্রকৃতি কখনো নিরপেক্ষ নয়, তবে নির্মোহ হতে পারে। মানব প্রকৃতি স্বভাবগতভাবেই কোন একপক্ষের প্রতি দুর্বল হয়ে থাকে, কোন একটি পক্ষের প্রতি তার মানসিক সমর্থন থাকে। মানসিকভাবেই সে কোন এক পক্ষের জয় ও অপর পক্ষের পরাজয় কামনা করে। তবে তার সেই পক্ষ সমর্থন ও মানসিক দুর্বলতা যুক্তি, বিবেক-বুদ্ধি, মানবিকতা ও মনুষ্যত্বের বিচারে সর্বোপরি ধর্মের মানদন্ডে সঠিক বা ভুল হতে পারে। পক্ষান্তরে বিভিন্ন ক্ষেত্রে নিরপেক্ষতার যে চর্চা রয়েছে তা ব্যক্তির প্রকৃতি ও স্বভাবগত নিরপেক্ষতা নয়, বরং তা হচ্ছে প্রকৃতি ও স্বভাবজাত পক্ষাবলম্বনকে বিবেক-বুদ্ধি ও ধর্মের মানদন্ডের বিরুদ্ধে নির্লজ্জভাবে বহিঃপ্রকাশ না করে নিজের মানসিক দুর্বলতা ও সমর্থনকে উপেক্ষা করে বিবেক ও যুক্তি এবং ধর্মীয় মানদন্ডকে প্রাধান্য দিয়ে মধ্যবর্তী অবস্থান গ্রহণ করা। সুতরাং ‘নিরপেক্ষতা’ শব্দটির প্রয়োগ ও ব্যবহার কতটুকু ব্যাপক হতে পারে এবং বাস্তবতার নিরিখে কোন কোন ক্ষেত্রে তা কতটুকু সম্ভব তা অবশ্যই বিচার্য।

আধুনিক বিশ্বে ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’শব্দটির বহুল ব্যবহার পরিলক্ষিত হচ্ছে এবং বর্তমানে এটি একটি রাষ্ট্রীয় মতবাদ ও আদর্শরূপে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে ধর্মের ক্ষেত্রে নিরপেক্ষতা শব্দটির প্রয়োগ কতটা যৌক্তিক ও বিশুদ্ধ? আর বাস্তবতাই বা তাকে কতটুকু সমর্থন করছে। আর কোন শ্রেণী, কেন এর ব্যবহার করছে? কেনই বা তারা এর রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠার জন্য অতি উৎসাহী? কি তাদের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য ইত্যাদির চুলচেরা বিশ্লেষণই আজকের নিবন্ধের মূল প্রতিপাদ্য।

ধর্মনিরপেক্ষতার সংজ্ঞা: প্রথমেই ধর্ম ও নিরপেক্ষতা দুটি শব্দকে স্বতন্ত্রভাবে সংজ্ঞায়িত করা যাক। নিরপেক্ষতা শব্দের অর্থ হচ্ছে পক্ষপাতহীনতা, কোন ক্ষেত্রে কোন পক্ষ অবলম্বন না করে মধ্যবর্তী অবস্থান গ্রহণ করা। আর ধর্ম হচ্ছে, স্রষ্টা কর্তৃক সৃষ্টির সঠিকভাবে পরিচালিত হওয়ার জন্য কিছু নীতিমালা তথা বিধি-নিষেধ যা তার ইহকালীন ও পরকালীন কল্যাণ নিশ্চিত করে।

আল্লাহ তায়ালাই একমাত্র স্রষ্টা। সৃষ্টিজগতের প্রতিটি একক তাঁর সৃষ্টিতত্ত্বের সেরা নৈপূণ্যের এক অপূর্ব নিদর্শন। তাঁর অগণিত সৃষ্টিকুলের মাঝে মানবজাতি হচ্ছে তাঁর অত্যন্ত আদুরে ও সেরা সৃষ্টি। মানবজাতিকে তিনি ইচ্ছা ও কর্মশক্তি এবং সিদ্ধান্তগ্রহণের স্বাধীনতার মতো বিশেষ কিছু গুণ ও ক্ষমতা প্রদান করেছেন। তাই বলে মানুষ লাগামহীন অশ্বের ন্যায় দিকভ্রান্ত কোন প্রাণী নয়। বরং তার ইচ্ছাশক্তি ও সিদ্ধান্তগ্রহণের স্বাধীনতা প্রয়োগে রয়েছে সুনির্দিষ্ট দিক নির্দেশনা। যে দিক নির্দেশনা প্রদান করেছেন স্বয়ং স্রষ্টা মহান আল্লাহ তায়ালা। সেটিরই পরিশীলিত রূপ হচ্ছে ধর্ম বা শরীয়ত। আর এটি বলাই বাহুল্য যে, বস্তুর উদ্ভাবক ও স্রষ্টা কর্তৃক নির্ধারিত ব্যবহার পদ্ধতিই বস্তুর সঠিক ব্যবহার ও কাংখিত উপকার এবং বস্তুর টিকে থাকার একমাত্র গ্যারান্টার। এর ব্যতিক্রমে হয়তো বস্তু তার সত্তা হারাবে অথবা বস্তু তার উপকারগুণ হারিয়ে বাহুল্যে পরিণত হবে। অতএব উপরোক্ত সংজ্ঞার আলোকে অতি সাধারণ থেকে সাধারণ একজন ব্যক্তির পক্ষেও সিদ্ধান্ত গ্রহণ খুবই সহজ যে, ধর্মের ক্ষেত্রে ‘নিরপেক্ষতা’ শব্দটির প্রয়োগ কোন সঠিক প্রয়োগ কি না এবং বাস্তবে ধর্মের ক্ষেত্রে নিরপেক্ষতার আদৌ কোন সুযোগ রয়েছে কি না। অন্তত দুটি ক্ষেত্র এমন রয়েছে যাতে কেউই নিরপেক্ষতার পরিচয় দিতে চায় না, বরং অবশ্যই একটা পক্ষের পরিচয় দেয়। ক্ষেত্র দুটি হলো বংশ ও ধর্ম। মানুষ যেমনিভাবে বংশের ক্ষেত্রে অবশ্যই পিতৃপরিচয় দিয়ে থাকে, এক্ষেত্রে নিরপেক্ষতার কোন সুযোগ নেই। তাইতো কাউকে জারজ বললে তার মাথায় রক্ত উঠে যায়। তেমনিভাবে ধর্মীয়ভাবেও মানুষ কোন একটি ধর্মের অনুসারী। তাইতো কাউকে ‘বে-ঈমান’ বললে সে তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠে। কারণ ধর্মের ক্ষেত্রে নিরপেক্ষতার অর্থ হচ্ছে ধর্মীয় ক্ষেত্রে জারজ। এটিই তাকে ক্রুদ্ধ করার কারণ।

এবার আসা যাক ‘ধর্মনিরপেক্ষতার’ সংজ্ঞায়। প্রকৃতপক্ষে কিছু বিষয় এমন রয়েছে যা এতই সুস্পষ্ট যে, তাকে সংজ্ঞায়িত করার প্রয়োজন পড়ে না। অতিসাধারণ ব্যক্তির পক্ষেও প্রথম শ্রবণেই তার মর্ম বোঝা সম্ভব। ধর্মনিরপেক্ষতাও এমনি একটি বিষয়। তবুও নিবন্ধের ধারাবাহিকতা রক্ষার খাতিরে তাকে সংজ্ঞায়িত করা হচ্ছে। ধর্মনিরপেক্ষতা যার ইংরেজী প্রতিশব্দ হচ্ছে Secularism, আরবীতে বলা হয় العلمانية (আল-আলমানিয়্যাহ) তবে Secularism এর সঠিক আরবী হচ্ছে اللادينية أو الدنيوية (আল-লাদীনিয়্যাহ অথবা দুনুবিয়্যাহ)। স্বাভাবিক অর্থে এর মর্ম হচ্ছে ধর্মের ব্যাপারে কোন পক্ষ তথা ধর্মকে অবলম্বন না করে মধ্যবর্তী অবস্থান গ্রহণ করা। এক কথায় কোন ধর্মকে অবলম্বন না করা। অভিধান ও উইকিপিডিয়াতেও উক্ত সংজ্ঞারই সমর্থন পাওয়া যায়। মুফতী আবুল হাসান আব্দুল্লাহ দামাত বারাকাতুহুমের মাসিক আল-কাউসার ম্যাগাজিনে প্রকাশিত ‘‘ধর্মনিরপেক্ষতা, সংবিধান ও ইসলাম’’ শীর্ষক নিবন্ধ থেকেই আমি উদ্ধৃত করছি। তিনি লিখেছেন,‘প্রথমেই দেখুন বাংলা একাডেমীর ইংলিশ-বাংলা ডিকশনারী। ২০১২ সালের এ সংস্করণ ছেপেছে জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী সাহেবের সম্পাদনায়। Secular অর্থ পার্থিব, ইহজাগতিকতা, জড়, জাগতিক। Secular State অর্থ হচ্ছে গীর্জার সাথে বৈপরিত্যক্রমে রাষ্ট্র। এ অর্থ অনুযায়ী মুসলিম দেশে এর ব্যাখ্যা হবে মসজিদের সঙ্গে বৈপরিত্যক্রমে রাষ্ট্র। Secularism হচ্ছে নৈতিকতা ও ধর্মকেন্দ্রিক হওয়া উচিত নয়—এই মতবাদ। এ অর্থগুলো লিখেছে বাংলা একাডেমীর অভিধান। এটির সম্পাদনায় কোন ইসলামপন্থী বা কোন হুজুর জড়িত ছিলেন না। দেশবরেণ্য ব্যক্তিত্ব জনাব জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী এর সম্পাদক। এটি এমন নয় যে, কোন মতবাদ ওয়ালারা নিজ মতবাদকে প্রতিষ্ঠা করার জন্য এ ব্যাখ্যা লিখেছে; বরং দেশের সরকার-নিয়ন্ত্রিত তথা সরকারী প্রতিষ্ঠান বাংলা একাডেমী, যারা সংবিধানে পুনরায় সেকুলারিজমকে স্থান দিয়েছেন তাদের কর্তৃক নিয়োজিত, নির্ভরযোগ্য ব্যক্তিরাই সেকুলারিজমের এই অর্থ ও ব্যাখ্যা দিয়েছেন। আমার পড়ে ভালো মনে হয়েছে যে, ওনারাও বস্তুনিষ্ট মানুষ। রাখঢাক না করে সাফ সাফ কথাটাই মানুষকে জানিয়ে দিয়েছেন। ‘ধর্মনিরপেক্ষতা ধর্মহীনতা নয়’ এমন কথা তারা লেখেননি। আমি বিশ্ববিখ্যাত অভিধানেও খোঁজ করেছি। ইনসাইক্লোপিডিয়া অব ব্রিটেনিকা দেখিছে, উইকিপিডিয়া দেখেছি। একই ব্যাখ্যা পেয়েছি। অক্সফোর্ড ইংরেজী-উর্দূ ডিকশনারীতে লিখা আছে Secularism অর্থ হচ্ছে لادينية ، لا مذهبية (ধর্মহীনতা)। এগুলো মুসলমানদের ব্যাখ্যা নয়। সেকুলারিজম যে বাস্তবেই لادينية، لا مذهبية (ধর্মহীনতা) এ ব্যাপারে তাদের মধ্যে মতভেদ দেখা যায় না। বাংলা একাডেমিরটা তো দেখলেনই। উইকিপিডিয়াতে সেকুলারিজমের ব্যাখ্যা করা হয়েছে Atheism and Irreligion দিয়ে।”

ধর্মনিরপেক্ষতার দর্শন

শাসন ও বিচার এবং ফায়ছালা: এ ক্ষেত্রে ধর্মনিরপেক্ষতার দর্শন হলো আল্লাহ তায়ালার নাযিলকৃত বিধানের আলোকে শাসন ও বিচার-ফায়ছালা সম্ভব নয়। বরং তা একমাত্র মানব রচিত আইনের আলোকেই হতে হবে। এক্ষেত্রে তারা ধর্মকে সম্পূর্ণরূপে ছুড়ে ফেলে দেয়।

অর্থনীতি: এ ক্ষেত্রে তাদের দর্শন হলো অর্থনীতির ক্ষেত্রে ধর্মের কোন ভূমিকা নেই। যার ফলে তারা সুদ, গুদামজাতকরণ এবং অন্যায় ও প্রতারণার মাধ্যমে অন্যের সম্পদ গ্রাসকে বৈধ মনে করে।

শিক্ষা: এ ক্ষেত্রে তাদের দর্শন হলো শিক্ষা হতে হবে ধর্মমুক্ত এবং তারা সহশিক্ষা।

ধর্মনিরপেক্ষদের শ্রেণী বিভাগ

ধর্মনিরপেক্ষরা দুই শ্রেণীতে বিভক্ত। এক. ধর্মনিরপেক্ষতাবাদীদের এক শ্রেণী আল্লাহ তায়ালা ও পরকালের বিচারের বিষয়টি অস্বীকার করে। দুই. অপর শ্রেণী আল্লাহ তায়ালার অস্তিত্বকে স্বীকার করে, তবে তাদের দর্শন হলো আল্লাহ তায়ালার ও বান্দার জীবনের মাঝে বিশ্বাস ও ব্যক্তিগত কাজকর্মের বাইরে কোন সম্পর্ক নেই। মু‘আমালাত, আর্থিক জীবন, শিক্ষা-দীক্ষা গ্রহণ ইত্যাদি ক্ষেত্রে বান্দা সম্পূর্ণরূপে মুক্ত -স্বাধীন। রাজনীতিতে ধর্মের প্রবেশ সম্পূর্ণরূপে নিষিদ্ধ এবং জীবন পরিচালিত হবে মানব রচিত নীতিমালার আলোকে।

ধর্মনিরপেক্ষতার উদ্ভব যেভাবে

গীর্জা কর্তৃক আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে নাযিলকৃত ধর্মের বিকৃতিসাধন, তাকে অনর্থকতায় পর্যবসিতকরণ এবং মানুষের নিকট তাকে ভয়ঙ্কররূপে উপস্থাপনের ফলে এবং মানুষের জন্য আল্লাহ তায়ালা কর্তৃক নাযিলকৃত ধর্ম ও বিধানের সঠিকরূপ সম্পর্কে অবগতি লাভের কোন মাধ্যম না থাকার ফলে ও শাসক গোষ্ঠীর কিছু স্বার্থ আর বিলাসিতার ক্ষেত্রে গীর্জাগুলো প্রতিবন্ধক হওয়ার কারণে ইউরোপে ধর্মনিরপেক্ষতার উদ্ভব ঘটে। ইউরোপের জনগোষ্ঠীর মাঝে কোন সঠিক ধর্মীয় চেতনা বা মূল্যবোধ বিদ্যমান ছিলো না। বরং জীবনের কোন কোন ক্ষেত্রে বিশেষ কোন শ্রেণীর মাঝে বিচ্ছিন্ন কিছু ধর্মীয় চেতনা বা মূল্যবোধ বিদ্যমান ছিলো। কিন্তু ধর্মনিরপেক্ষতার মতবাদের উদ্ভব তাদের সেই বিচ্ছিন্ন ধর্মীয় মূল্যবোধটুকুকেও তাদের জীবন থেকে ছুঁড়ে ফেলে দেয়। ধর্মনিরপেক্ষতা তাদেরকে উপহার দেয় ধর্ম গ্রহণ করা বা নিজেকে ধর্মের বাঁধনমুক্ত রাখার তথাকথিত স্বাধীনতা। এক কথায় বিকৃত আকীদা, দীনকে ইবাদত অর্থে সীমাবদ্ধকরণ, রাষ্ট্র পরিচালনা ও সর্বস্তরে ধর্মীয় ব্যক্তিত্বগণের অভাব, ধর্মীয় ব্যক্তিত্বদের নিজেদের স্বার্থ ও সুবিধার লক্ষ্যে হালালকে হারাম ও হারামকে হালালকরণ, গীর্জার ব্যক্তিত্বদের চারিত্রিক অধঃপতন এবং সর্বোপরি রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক অন্যায় অবিচারে গীর্জার সহযোগিতা ও সমর্থন ধর্মনিরপেক্ষতার উদ্ভবের পথ উন্মুক্ত করে দেয়।

মুসলিম দেশে ধর্মনিরপেক্ষতার অনুপ্রবেশ

মুসলিম দেশে ধর্মনিরপেক্ষতার অনুপ্রবেশের কারণ হলো বিশাল একটি মুসলিম জনগোষ্ঠীর কিতাব-সুন্নাহ ও সালফে ছালেহীনের প্রদর্শিত ছহীহ আকীদা ও বিশুদ্ধ চিন্তা-চেতনার বিকৃতি এবং পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদের বিভিন্ন মুসলিম দেশে সামরিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক আগ্রাসন।

ভারতবর্ষে ১৭৯১ ঈসাব্দ পর্যন্ত ইসলামী বিধান চালু ছিলো, কিন্তু ইংরেজ বৃটিশ বেনিয়াদের ষড়যন্ত্রের ফলে উনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে তার অবসান ঘটে। আলজেরিয়ায় ১৮৩০ ঈসাব্দে ফরাসী বিপ্লবের পর ইসলামী বিধানের অবসান ঘটে। তিউনিসিয়ায় ১৯০৬ ঈসাব্দে ফরাসী আইন প্রবর্তিত হয়। মরক্কোতে ১৯১৩ ঈসাব্দে ফরাসী আইন প্রবর্তিত হয়। তুরস্কে কামাল আতাতুর্কের হাতে ইসলামী খেলাফতের অবসানের পর ধর্মনিরপেক্ষতা প্রতিষ্ঠিত হয়। সিরিয়া ও ইরাকে উছমানী খেলাফত ধ্বংসের পর ইংরেজ ও ফরাসীদের উত্থান ঘটে এবং ইসলামী বিধানের অবসান ঘটে। এভাবেই মুসলিম দেশগুলোতে ধর্মনিরপেক্ষতার অনুপ্রবেশ ঘটে। এরই ধারাবাহিকতায় ইন্দোনেশিয়া হয়ে যায় দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার সর্বাপেক্ষা বড় ধর্মনিরপেক্ষ দেশ। এদের একটি ব্যাখ্যা বই-পুস্তকে পাওয়া যায়, যার সংক্ষিপ্ত রূপ হলো, ধর্ম যার যার রাষ্ট্র সবার। অর্থাৎ রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে, সরকারের নীতি নির্ধারণের ক্ষেত্রে নাগরিকদের কোন ধর্মকে প্রাধান্য না দেয়া, ক্ষেত্রে বিশেষে ধর্মকে সম্পৃক্ত না করা। তবে সরকার পরিচালনাকারী তার ব্যক্তিগত, পারিবারিক ও সামাজিক জীবনে কম-বেশী ধর্ম অনুসরণ করতে পারবেন। যেমন— মালয়েশিয়া, আলজেরিয়া, মরক্কো, বাংলাদেশ ইত্যাদি।

মুসলিম বিশ্বে প্রসিদ্ধ ধর্মনিরপেক্ষতার প্রচারকগণ

আহমদ লুতফী আস-সাইয়্যেদ, ইসমাঈল মাযহার, কাসেম আমীন, তহা হোসাইন, আব্দুল আযীয ফাহমী, সুকার্নো, সোহর্ত, মোস্তফা কামাল আতাতুর্ক, জামাল আব্দুন নাছের, আনোয়ার সাদাত (তার বিশ্বাস ছিলো, ধর্মে কোন রাজনীতি নেই এবং রাজনীতিতে কোন ধর্ম নেই।) ড. ফুয়াদ যাকারিয়া।

বর্তমান ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ ও প্রাচীন জাহেলিয়াতের মাঝে সাদৃশ্য

প্রাচীন জাহেলী যুগের বিশ্বাস ও আকীদাসমূহ সম্পর্কে অবগত ব্যক্তি মাত্রই জানে যে, তারা কখনো আল্লাহ তায়ালার অস্তিত্বকে অস্বীকার করতো না। বরং তারা সৃষ্টি, জীবিকাপ্রদান, জীবন ও মৃত্যুদান ইত্যাদি বৃহৎ কতক কর্মে আল্লাহ তায়ালার একক ক্ষমতার স্বীকৃতিও প্রদান করতো। যেমন— আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন, وَلَئِنْ سَأَلْتَهُمْ مَنْ خَلَقَ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضَ لَيَقُولُنَّ اللَّهُ- আপনি যদি তাদেরকে জিজ্ঞেস করেন, নভোমন্ডল ও ভূ-মন্ডল কে সৃষ্টি করেছে? তারা অবশ্যই বলবে, আল্লাহ । (লুকমান:২৫) তারা ফেরেশতাদের প্রতিও বিশ্বাস পোষণ করতো। যেমন- কোরআনে কারীমে রয়েছে, وَقَالَ الَّذِينَ لا يَرْجُونَ لِقَاءَنَا لَوْلا أُنْزِلَ عَلَيْنَا الْمَلائِكَةُ- যারা আমার সাক্ষাৎ আশা করে না, তারা বলে, আমাদের কাছে ফেরেশতা অবতীর্ণ করা হল না কেন? (ফুরকান:২১) তারা রসূলের প্রতিও বিশ্বাস স্থাপন করতো। وَإِذَا جَاءَتْهُمْ آَيَةٌ قَالُوا لَنْ نُؤْمِنَ حَتَّى نُؤْتَى مِثْلَ مَا أُوتِيَ رُسُلُ اللَّه- যখন তাদের কাছে কোন আয়াত পৌঁছে, তখন বলে, আমরা কখনই মানব না যে, পর্যন্ত না আমরাও তা প্রদত্ত হই, যা আল্লাহর রসূলগণ প্রদত্ত হয়েছেন। (আন‘আম:১২৪) তারা স্বীকার করতো জীবিকা প্রদান, শ্রবণশক্তি ও দৃষ্টিশক্তি এবং জীবন ও মৃত্যু এ সবই আল্লাহ তায়ালার কর্তৃত্বধীন। যেমন— কোরআনে কারীমে বিবৃত হয়েছে, قُلْ مَنْ يَرْزُقُكُمْ مِنَ السَّمَاءِ وَالْأَرْضِ أَمَّنْ يَمْلِكُ السَّمْعَ وَالْأَبْصَارَ وَمَنْ يُخْرِجُ الْحَيَّ مِنَ الْمَيِّتِ وَيُخْرِجُ الْمَيِّتَ مِنَ الْحَيِّ وَمَنْ يُدَبِّرُ الْأَمْرَ فَسَيَقُولُونَ اللَّهُ . তুমি জিজ্ঞেস কর, কে রুযী দান করে তোমাদেরকে আসমান থেকে ও যমীন থেকে, কিংবা কে তোমাদের কান ও চোখের মালিক? তাছাড়া কে জীবিতকে মৃতের ভেতর থেকে বের করেন এবং কেইবা মৃতকে জীবিতের মধ্য থেকে বের করেন? কে করেন কর্ম সম্পাদনের ব্যবস্থাপনা? তখন তারা বলে উঠবে, আল্লাহ! (ইউনুস:৩১) তারা অনেক ইবাদতসংক্রান্ত বিষয়ও পালন করতো। যেমন— বাইতুল্লাহর সম্মান প্রদর্শন, বাইতুল্লাহ তাওয়াফ করা, আরাফায় অবস্থান করা, সম্মানিত মাসসমূহকে সম্মান করা ইত্যাদি। জাহেলী যুগে আরবরাও কিছু শরীয়তের হদ্দও প্রয়োগ করতো। যেমন— তারা চুরির দায়ে হস্তকর্তন করতো।

অতএব, জাহেলী যুগে যেমনিভাবে তাদের এ সকল বিশ্বাস ও ইবাদত পালন সত্ত্বেও যতক্ষণ পর্যন্ত তারা ইসলামের প্রকৃত ও পরিপূর্ণ আকীদা বিশ্বাস স্থাপন করেনি এবং যে সকল নেতিবাচক বিশ্বাস পরিহার করা আবশ্যক তা করেনি, ততক্ষণ পর্যন্ত তারা কুফরের গন্ডি থেকে ইসলামের গন্ডিভুক্ত হতে পারেনি। ঠিক তেমনিভাবে কেউ শুধু নিজেকে মুসলমান দাবী করলে এবং অনুরূপ ইবাদতকর্ম পালন করলেই ইসলামের গন্ডিভূক্ত থাকবে না, যতক্ষণ পর্যন্ত ইসলামের প্রকৃত ও পরিপূর্ণ আকীদা বিশ্বাস স্থাপন না করে। বর্তমানের ধর্মনিরপেক্ষতাবাদীরা একদিক থেকে জাহেলী যুগের লোকদের চেয়েও আরো এক ধাপ এগিয়ে রয়েছে। তা হচ্ছে ধর্মের উর্ধ্বে বিচরণ করা। জাহেলী যুগের লোকেরা কেউই ধর্মের উর্ধ্বে বিচরণ করেনি। বরং তাদের কেউ হযরত ইবরাহীম আ.-এর ধর্মের অবশিষ্ট রীতি-নীতির অনুসারী ছিলো, যেমন— ইহূদী-খৃস্টান। আবার কেউ ছিলো নক্ষত্ররাজির পূজারী, কেউ মূর্তিপূজারী, আবার কেউ জিন্ন বা ফেরেশতার পূজারীও ছিলো। মোটকথা তাদের কেউ ধর্মের উর্ধ্বে নিজের অবস্থান গ্রহণ করেনি। বরং নিজেকে ধর্মের গন্ডিভূক্তই রেখেছে।

ধর্মনিরপেক্ষতার অপর নাম ধর্মহীনতা

ধর্মকে জীবন থেকে বিচ্ছিন্ন করে ভাবার কোনই অবকাশ নেই। ধর্মকে জীবন থেকে বিচ্ছিন্ন ও দুটিকে দু মেরুর ভাবার অর্থ হচ্ছে ইসলামকে একটি পরিপূর্ণ ধর্ম ও জীবন হিসাবে অস্বীকার করা। অথচ আল্লাহ তায়ালা ইসলামকে একটি পূর্ণাঙ্গ জীবন বিধানরূপে আখ্যায়িত করেছেন। আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেছেন, الْيَوْمَ أَكْمَلْتُ لَكُمْ دِينَكُمْ وَأَتْمَمْتُ عَلَيْكُمْ نِعْمَتِي وَرَضِيتُ لَكُمُ الْإِسْلامَ دِينًا – আজ আমি তোমাদের জন্যে তোমাদের দীনকে পূর্ণাঙ্গ করে দিলাম, তোমাদের প্রতি আমার অবদান সম্পূর্ণ করে দিলাম এবং ইসলামকে তোমাদের জন্যে দ্বীন হিসেবে পছন্দ করলাম। (মায়িদা:৩) উক্ত আয়াতে আল্লাহ তায়ালা সুস্পষ্টভাবে ঘোষণা করেছেন যে, দীনকে তিনি পূর্ণাঙ্গ করে দিয়েছেন। এ কথা বলাই বাহুল্য যে, ব্যক্তির জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র, রাজনীতি, অর্থনীতি ও পরকালীন বিষয়াবলী ইত্যাদি সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম ও ক্ষুদ্রাতি ক্ষুদ্র সবকিছুর সুস্পষ্ট নির্দেশনাই হচ্ছে দীন। অতএব কেউ যদি বলে ইসলামে মানব জীবনের কোন এক দিকের কোন প্রকার নির্দেশনা নেই এবং মানব জীবনে তার আবেদন গৌণ, তবে সে প্রকারান্তরে এ আয়াতকেই অস্বীকার করলো। তথাপি আরো বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকেও ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ একটি কুফরী মতবাদ এবং এটি ধর্মহীনতারই নতুন সংস্করণ। নিম্নে কয়েকটি দিক উপস্থাপিত হলো।

এক. আকীদা ও বিশ্বাসগতভাবে ধর্মনিরপেক্ষতা হচ্ছে ধর্মকে অস্বীকার করা, ধর্মের প্রতি ও তার বিধিবিধানগুলোকে অস্বীকার করা। আর এটি যে সুস্পষ্ট কুফরী তা বলাই বাহুল্য।

দুই. বিধানগত দিক থেকে ধর্মনিরপেক্ষতা হলো, ধর্মকে রাষ্ট্র থেকে সম্পূর্ণরূপে ছিন্ন করা এবং ধর্মকে জীবনের সকল ক্ষেত্র থেকে সম্পূর্ণরূপে ছিন্ন করে ফেলা। এটিই হচ্ছে আল্লাহর বিধানের ব্যতিক্রম ফায়ছালা করা। আর এ সম্পর্কে কোরআনে কারীমে রয়েছে, وَمَنْ لَمْ يَحْكُمْ بِمَا أَنْزَلَ اللَّهُ فَأُولَئِكَ هُمُ الْكَافِرُونَ- যেসব লোক আল্লাহ যা অবতীর্ণ করেছেন, তদনুযায়ী ফায়সালা করে না, তারাই কাফের। (মায়িদা:৪৪) وَمَنْ لَمْ يَحْكُمْ بِمَا أَنْزَلَ اللَّهُ فَأُولَئِكَ هُمُ الظَّالِمُونَ-যেসব লোক আল্লাহ যা অবতীর্ণ করেছেন, তদনুযায়ী ফয়সালা করে না তারাই জালেম।(মায়িদা:৪৫) وَمَنْ لَمْ يَحْكُمْ بِمَا أَنْزَلَ اللَّهُ فَأُولَئِكَ هُمُ الْفَاسِقُونَ- যারা আল্লাহ যা অবতীর্ণ করেছেন, তদনুযায়ী ফয়সালা করে না, তারাই পাপাচারী। (মায়িদা:৪৭) এ সম্পর্কে উলামায়ে কেরামের বক্তব্য হলো, যদি কোন ফায়ছালাকারী বা শাসক এভাবে আল্লাহ তায়ালার হুকুমের বিপরীতে ফায়ছালা করে যে, আল্লাহ তায়ালার হুকুম উপযোগী নয়, অথবা তাদের প্রণীত বিধান মানব প্রয়োজনে পূর্ণাঙ্গ ও পরিব্যাপ্ত, অথবা তাদের প্রণীত বিধান আল্লাহ ও রসূলের বিধানের সমপর্যায়ের, বা আল্লাহ ও রসূলের বিধানের বিপরীতে ফায়ছালা করাকে বৈধ মনে করে, তাহলে তা কুফরী এবং সে ইসলামের গন্ডি বহির্ভূত হয়ে যাবে।

এ প্রসঙ্গে সউদী আরবের সাবেক গ্র্যান্ড মুফতী শায়খ আব্দুল্লাহ বিন বায বলেন, যে এরূপ বিশ্বাস পোষণ করে যে, মানব রচিত বিধান শরীয়তের বিধান অপেক্ষা উত্তম অথবা তার সমকক্ষ, অথবা মানব রচিত বিধানের আলোকে ফায়ছালা করা বৈধ, তবে সে ইসলামের গন্ডি বহির্ভূত। তেমনিভাবে যে মনে করে চুরির দায়ে হস্তকর্তন, ব্যভিচারের দায়ে প্রস্তরাঘাতে হত্যা ইত্যাদি বিধান বর্তমান যুগের জন্য উপযোগী নয়। অথবা যে মনে করে লেনদেন, শাস্তির বিধান ইত্যাদি ক্ষেত্রে শরীয়তের বিধানের বাইরে ফায়ছালা করা বৈধ সেও ইসলামের গন্ডি বহির্ভূত। কারণ সে হারামকে হালাল বলে বিশ্বাস করেছে। আর হারামকে হালাল বলে বিশ্বাসকারী ব্যক্তি মুসলমানদের সর্বসম্মতিক্রমে কাফের।

আর যদি এরূপ বিশ্বাস পোষণ করে যে, আল্লাহ ও তাঁর রসূলের বিধান মানব রচিত বিধান অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ, কিন্তু অজ্ঞতা বা দুর্বলতাবশত অথবা নিজের প্রবৃত্তির তাড়নায় বা কোন পার্থিব স্বার্থে আল্লাহ ও তাঁর রসূলের হুকুমের বিপরীতে ফায়ছালা করে, তবে তা কুফরী কর্ম বলে গণ্য হবে।

তিন. আখলাক ও চারিত্রিক দৃষ্টিকোণ থেকে ধর্মনিরপেক্ষতা সমাজে অশ্লীলতা, নগ্নতার প্রসার ঘটায় এবং ধর্ম ও নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সুন্নাহ ইত্যাদির প্রতি তাচ্ছিল্য সৃষ্টি করে। যা সুস্পষ্ট ভ্রষ্টতা ও পৃথিবীতে বিপর্যয় সৃষ্টি করে। অনেক ধর্মনিরপেক্ষতাবাদী মনে করে ইসলামের রীতি-নীতি, সুন্নাহ ও ইসলামী আখলাক অন্ধ অনুকরণ। এটি একটি জাহেলী চিন্তা-চেতনা।

ধর্মনিরপেক্ষতার ভয়াবহতা

ধর্ম নিরপেক্ষতার বাতিক একটি জাতিকে কত উঁচু থেকে কত নিচুতে নিক্ষেপ করতে পারে তার নজির আপনি দেখতে পাবেন এক সময়কার সালতানাতে উসমানিয়ার রাজধানী তুরস্কে। যে তুরস্ক এক সময় শাসক করেছিলো হারামাইন শরীফাইনসহ পৃথিবীর একটি বিশাল অংশ। শত শত বছরের সে উসমানী খেলাফতের কেন্দ্রবিন্দুই শেষের দিকের সুলতানদের অযোগ্যতা-অদক্ষতা ও অপরিণামদর্শিতার কারণে ধর্মনিরপেক্ষতাবাদীদের স্বর্গরাজ্যে পরিণত হয়েছিলো। কামাল আতাতুর্ক হলো ধর্মনিরপেক্ষতাবাদীদের আদর্শ ব্যক্তি, যে এই তুরস্কেই সেক্যুলারিজমকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিয়েছিলো। আতাতুর্ক তুরস্কে কী কী ঘটিয়েছিলো তা হয়তো ইতিহাস সম্পর্কে সচেতন ব্যক্তিদের জানা।

বর্তমানে আমাদের দেশে সেক্যুলারপন্থী দলটি ক্ষমতাসীন হওয়ার পর থেকে এবং সংবিধান থেকে ‘আল্লাহর উপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস’ বাদ দিয়ে তার স্থলে সেক্যুলারিজমকে প্রতিষ্ঠা করার পর থেকে আমাদের দেশের অবস্থা কোন দিকে যাচ্ছে, আমাদের শিক্ষা ও সংস্কৃতিতে আমাদের পরবর্তী প্রজন্মকে কোন চেতনায় গড়ে তোলা হচ্ছে, যে কোন সচেতন ব্যক্তি মাত্রই তা জেনে আতঙ্কিত হয়ে উঠবেন। অতএব আমাদেরকে চোখ, কান খোলা রেখে ধর্মনিরপেক্ষতার অভিশাপ সম্পর্কে অবগত হয়ে নিজ নিজ গন্ডি থেকে সামর্থের সবটুকু দিয়ে জাতি এর বিষের প্রভাবে নীল হয়ে যাওয়ার পূর্বে তাদেরকে সতর্ক ও সচেতন করতে হবে।

আমাদের অনেকের মধ্যে বর্তমান ধর্মনিরপেক্ষদের ব্যাপারে এ বলে কিছুটা নমনীয়তা রয়েছে যে, তারা ধর্মনিরপেক্ষতা বলতে স্বাধীনভাবে সব ধর্ম পালনের অধিকারকে বুঝায়, এটি সম্পূর্ণরূপে ভ্রান্ত ও আত্মপ্রবঞ্চনা এবং প্রতারিত হওয়া। যদি তাই হতো তাহলে কেন শিক্ষা মন্ত্রণালয়, শিক্ষা কমিশন ও শিক্ষা মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত স্থায়ী কমিটি, তিনটি ক্ষেত্রেই যথাক্রমে নূরুল ইসলাম নাহিদ, কবির চৌধুরী (বর্তমানে তার মৃত্যুর পর অন্য কেউ তার স্থলাভিষিক্ত হয়েছে) ও রাশেদ খান মেননের মতো বামপন্থী ও সেক্যুলাররা অবস্থান করছে? শিক্ষার গুরুত্বপূর্ণ এ তিনটি ক্ষেত্রে এরূপ তিন ব্যক্তির নিযুক্তি কি এ কথা প্রমাণ করে না যে, যারা ধর্ম নিরপেক্ষতার উপরোক্ত ব্যাখ্যা দেয় তা তাদের খোলস মাত্র এবং জনগণকে প্রতারিত করার উপায়। প্রকৃতপক্ষে এরা কামাল আতাতুর্কেরই প্রেতাত্মা এবং তার প্রদর্শিত সেই ইসলাম ধর্মমুক্ত ও ইসলামী বিরোধী একটি শিক্ষানীতির মাধ্যমে একটি ইসলাম বিরোধী প্রজন্ম গড়ে তোলাই তাদের মূল লক্ষ্য ও মিশন। যদি তাদের ব্যাখ্যাই সঠিক হতো, তাহলে কেন এদেশের আদালত স্বপ্রণোদিত হয়ে রুল জারি করে যে, কোন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কোন ছাত্রীকে বোরকা পরতে বাধ্য করা যাবে না। কেন কোন কোন বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ছাত্রীদের জন্য বোরকা নিষিদ্ধ করে, কেন ছাত্রদের জন্য ধর্মীয় পোষাক নিষিদ্ধ করে? এগুলো কামাল আতাতুর্কের সেই তুরস্কের পদধ্বনি নয় কি? তাছাড়া তাদের এ ব্যাখ্যা তখনি সঠিক হতো যদি ধর্মনিরপেক্ষতা সংবিধানে প্রতিষ্ঠিত করার পূর্বে এদেশের সংখ্যালঘুরা তাদের ধর্ম পালনে কোন বাধার সম্মুখীন হতো আর পরে স্বাধীনভাবে তা পালন করতে পারতো। এমনটি তো ঘটেনি। এদেশের সংখ্যালঘুরা বরং বরাবরই তাদের ধর্মীয় স্বাধীনতা ভোগ করে আসছে। তাদের এ ব্যাখ্যা যে ভন্ডামী এবং তাদের ধর্মনিরপেক্ষতা যে কামাল আতাতুর্কের তুরস্কের জন্ম দেয়ার লক্ষ্যে তার প্রমাণ হচ্ছে ধর্মনিরপেক্ষরা ক্ষমতাসীন হওয়ার পর থেকে এদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ সিংহভাগ মুসলিম তাদের ধর্মীয় স্বাধীনতা হারিয়েছে। এদেশের তরুণ-যুবকরা কি ঠিক মতো নামায আদায় করতে পারছে? (র‌্যাবের ডিজি যখন কোন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অনুষ্ঠানে বলে, কোন ছাত্রের মাঝে ধর্মের প্রতি অনুরাগ লক্ষ্য করলে আমাদেরকে অবহিত করতে হবে, তাহলে কি তরুণদের নামায আদায়ের স্বাধীনতা রইলো?) ইমাম-খতীবগণ কি অকপটে স্বাধীনচিত্তে নির্ভয়ে ধর্মের সঠিক ব্যাখ্যা মনখুলে বলতে পারছেন? (সেক্যুলারদের দলটি যখন তাদের নেতা-কর্মীদের নির্দেশ দেয় জুমার দিন খতীব সাহেব কি বলেন, তা রেকর্ড করার জন্য মসজিদে যেতে এবং প্রশাসন যখন জুমআর দিনে মসজিদে মসজিদে গোয়েন্দা নিযুক্ত করে আর সত্যভাষণের ফলে যখন ইমাম-খতীবগণ শারিরীকভাবে ও মানসিকভাবে লাঞ্ছিত হন এবং চাকরিচ্যূত হন, তখন তাদের স্বাধীনতা থাকলো কোথায়?) ইমাম-খতীবগণ কি স্বাধীনভাবে দোয়া-মুনাজাত করতে পারেন? বক্তাগণ কি স্বাধীনভাবে ইসলামের সঠিক ব্যাখ্যা ওয়ায-মাহফিলে সাধারণ জনগণের নিকট তুলে ধরতে পারেন?

বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম ও ধর্মনিরপেক্ষতা

ভারত উপমহাদেশে সাম্রাজ্যবাদী ইংরেজ-শাসনের কলঙ্কজনক ইতিহাস সকলের জানা। ইংরেজদের যুলুম-নির্যাতন এবং সর্বোতভাবে মানবাধিকারের পদদলন, মানুষের অর্থনৈতিক, সামাজিক, রাজনৈতিক ও ধর্মীয়সহ সকল স্বাধীনতা হরণের মাধ্যমে তারা ভারত উপমহাদেশকে পরিণত করেছিল এক নরক খন্ডে। সেই যুলুমবাজ ইংরেজ সরকার দুইশত বছর রাজত্বের ফলে যাদের শেকড় অনেক গভীরে প্রোথিত হয়েছিল তাদের থেকে এই ভারতবর্ষকে মুক্ত করার জন্য ও ভারতবর্ষের স্বাধীনতার জন্য কারা জানবাজি রেখে স্বাধীনতা সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল? কাদেরকে ঝুলানো হয়েছিল ফাঁসিকাষ্ঠে? কাদের রক্তস্রোতে ভারতবর্ষের জমিন লাল হয়েছিল? কারা বন্দিত্ব বরণ করেন মাল্টার কালো পানির দ্বীপে? কাদেরকে গরম তেলে নিক্ষেপ করা হয়েছিল? তাঁরা ছিলেন উলামায়ে কেরাম। উলামায়ে কেরামের রক্ত আর আত্মদানের উপরই প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল অবিভক্ত ভারতবর্ষের স্বাধীনতা। ১৮৬৪ ঈসাব্দ থেকে ১৮৬৭ ঈসাব্দ পর্যন্ত তিন বছরে ইংরেজরা ১৪ হাজার আলেমকে ফাঁসিকাষ্ঠে ঝুলিয়েছিল। দিল্লীর চাঁদনী চক থেকে নিয়ে খায়বার পর্যন্ত এমন কোন গাছ ছিল না যার শাখায় কোন আলেমের লাশ ঝুলেনি। উলামায়ে কেরামের রক্তস্নাত এই স্বাধীনতার পর ভারতবর্ষ বিভক্ত হল দু‘ভাগে। পাকিস্তান ও হিন্দুস্তান। পাকিস্তান ও হিন্দুস্তানের বিভক্তি হয়েছিল কিসের ভিত্তিতে? ধর্মের ভিত্তিতে। হিন্দু প্রধান অঞ্চল নিয়ে গঠিত হল হিন্দুস্তান বা ভারত। আর মুসলিম প্রধান অঞ্চল নিয়ে গঠিত হল পাকিস্তান। অতঃপর পাকিস্তান বিভক্ত হয়ে সৃষ্টি হল বাংলাদেশের। পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের কারণ কী ছিল? এ ব্যাপারে বিভিন্নজন বিভিন্নভাবে নিজের অবস্থান থেকে অনেক কারণ উল্লেখ করলেও ঐতিহাসিক সত্য হল রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বৈষম্যই ছিল এর মূল কারণ। এবং এর পেছনে ধর্মীয় কোন কারণ ছিল না তাও ঐতিহাসিকভাবে সত্য ও বোদ্ধাজন কর্তৃক স্বীকৃত। কারণ পাকিস্তানের তৎকালীন শাসক গোষ্ঠীর সাথে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান ও বর্তমান স্বাধীন বাংলাদেশের রাজনৈতিক নেতৃত্ব ও সাধারণ জনগনের সাথে ধর্মীয় কোন বিরোধ ছিল না। কিন্তু অত্যন্ত দুঃখ ও পরিতাপের বিষয় হল স্বাধীনতার চল্লিশ বছর পর যখন বাংলাদেশ উন্নতি ও অগ্রগতির পথে অত্যন্ত দৃঢ়ভাবে অগ্রসর, তখন এক শ্রেণীর মতলববাজ বহিঃশক্তির দালাল ও তল্পিবাহক সেই ইতিহাসকে বিকৃত করে ঐতিহাসিকভাবে স্বীকৃত একটি বিষয়কে বিতর্কিত করার লক্ষ্যে ধর্মনিরপেক্ষতাকে স্বাধীনতার চেতনা বলে প্রচার করছে। যারা ধর্মনিরপেক্ষতাকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বলে, তাদের কাছে জিজ্ঞাসা; ঐতিহাসিক ছয়দফা, ৬৯ এর গণঅভ্যূথান, ৭০-এর নির্বাচন, পঁচিশে মার্চের শেখ মুজিবের ভাষণ, স্বাধীনতার ইশতেহার বা মুজিবনগর সরকার অথবা স্বাধীনতা সংগ্রামের পূর্বাপর কোন বক্তৃতা বা ঐতিহাসিক দলীল কোথাও কি ধর্মনিরপেক্ষতার কথা ছিল? স্বাধীনতা যুদ্ধে বাংলাদেশের আপামর জনসাধারণকে সম্পৃক্ত হওয়ার জন্য উদ্ধুদ্ধকরণ কার্যাবলী তথা বক্তৃতা ইত্যাদি কোন কিছুতে কি ধর্মনিরপেক্ষতার কথা ছিলো? বর্তমানেও স্বাধীনতা সংগ্রামকে কেন্দ্র করে রচিত গল্প-নাটকের কোন চরিত্রে কি দেখা যায় কেউ কাউকে ধর্মনিরপেক্ষতা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে বাংলাদেশ স্বাধীন করার জন্য উৎসাহিত করছে? স্বাধীনতা যুদ্ধে কতজন মুক্তিযোদ্ধা ধর্মনিরপেক্ষ ছিলেন, আর কতজন মুক্তিযোদ্ধা মুসলমান বা অন্য ধর্মাবলম্বী ছিলেন? ধর্মনিরপেক্ষতাকে যদি স্বাধীনতার চেতনা বলা হয় তাহলে স্বাধীনতা যুদ্ধে প্রাণদানকারী এত বিশাল সংখ্যক মুসলিম মুক্তিযোদ্ধার মুক্তিযুদ্ধকে অস্বীকার করা হয় ও তাদের আত্মার সাথে গাদ্দারী করা হয়। প্রকৃতপক্ষে স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় কোন মুক্তিযোদ্ধাই জানতো না তারা ধর্মনিরপেক্ষতার জন্য সংগ্রাম করছে। তারা বরং জানতো জালিমের কবল থেকে দেশের মানুষকে ও দেশকে মুক্ত করার জন্য তারা যুদ্ধ করছে। ধর্মনিরপেক্ষতাই যদি মুক্তিযুদ্ধের চেতনা হতো তাহলে ধর্মনিরপেক্ষার ধ্বজাধারী আওয়ামীলীগকে ক্ষমতা লাভের জন্য দীর্ঘ ২১ বছর সংগ্রাম করতে হত না। সম্ভবত পৃথিবীর ইতিহাসে স্বাধীনতা সংগ্রামে নেতৃত্বদানকারী অন্যতম জনপ্রিয় নেতা শেখ মুজিবের মৃত্যুর পর তার জানাযায় অংশগ্রহণকারী লোক সংকটের এটিও একটি অন্যতম কারণ যে, তিনি ৭২ এর সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতাকে প্রতিষ্ঠিত করে মুক্তিযোদ্ধাগণ ও বাংলাদেশের সাধারণ জনগণের মূলচেতনায় আঘাত হেনেছিলেন। সম্ভবত এ কারণেই স্বাধীনতার ঘোষণাকারী মতান্তরে ঘোষণা পাঠকারী জেডফোর্সের কমান্ডার মুক্তিযোদ্ধা শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় আরোহণের পর প্রথমেই এটিকে ছুঁড়ে ফেলেছিলেন এবং পরবর্তীতে অনেক সেক্টর কমান্ডারকেই জনগণ ধার্মিকরূপে পেয়েছে।

বাংলাদেশের জনগণ, গণতন্ত্র, সংবিধান ও ধর্মনিরপেক্ষতা

বাংলাদেশের জনগণ ধর্মপ্রাণ। তাইতো পৃথিবীর সর্বাপেক্ষা জনবহুল নগরী ঢাকা মসজিদের শহর হিসাবে খ্যাত এবং মসজিদগুলো কখনো মুসল্লীশূন্য থাকে না, বরং সব সময় মুসল্লীতে পূর্ণ থাকে। ধর্মের ব্যাপারে এদেশের মানুষ কখনো আপোষ করে না। জীবন দিয়ে হলেও ধর্মের বিধানকে রক্ষায় সচেষ্ট থাকে। হয়তো কখনো কোন যুলুমবাজের ক্ষমতার দন্ড তাদেরকে চুপসে দেয়, কিন্তু তাদের ক্ষোভ কিছুতেই নিবারিত হয় না। আর কোন দেশের সংবিধান রচিত হয় সে দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠীর বিশ্বাস ও চেতনার আলোকে। সুতরাং এদেশের সংবিধান অবশ্যই রচিত হওয়া উচিত সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানদের বিশ্বাস ও চিন্তা-চেতনার আলোকে। আর ধর্মনিরপেক্ষতা যেহেতু ইসলামের সাথে সাংঘর্ষিক এবং কুফরী মতবাদ সেহেতু তা সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিমের দেশের সংবিধানে থাকতে পারে না।

এদেশ যেহেতু বর্তমানে গণতন্ত্র দ্বারা শাসিত হচ্ছে। আর গণতন্ত্রের নীতি হচ্ছে সংখ্যাগরিষ্ঠের নীতি অনুসারে সিদ্ধান্ত গৃহীত হবে। সুতরাং গণতান্ত্রিক দৃষ্টিকোণ থেকেও বাংলাদেশের সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতা থাকতে পারে না। বরং আল্লাহর উপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাসই হবে সংবিধানের মূল স্পিরিট। কেননা এক্ষেত্রে ৯০ভাগ মুসলমান অবশ্যই নিজেদেরকে মুসলমান হিসাবে বজায় রাখতে হলে ধর্মনিরপেক্ষতার বিপক্ষেই অবস্থান নিতে হবে। কারণ ধর্মনিরপেক্ষতা ইসলামের সাথে সাংঘর্ষিক ও কুফরী মতবাদ হওয়ার ফলে সে পক্ষে অবস্থান নেয়ার কোন সুযোগ নেই।

মতলববাজদের মুখোশ উন্মোচন

ধর্মনিরপেক্ষতাকে রাষ্ট্রীয় মতবাদ হিসাবে প্রতিষ্ঠাকারী মতলববাজরা যে বহির্শক্তির এজেন্ট, উচ্ছিষ্টভোগী ও দালাল তা আজ জাতির কাছে দিবালোকের ন্যায় সুস্পষ্ট। কারণ যে দুই যুগের বেশী সময় সংবিধানে এ বিষয়টি ছিল না তখন কি এদেশে শান্তিপূর্ণ ধর্মীয় সহাবস্থান ছিল না? ঐ সময়ের মধ্যে আওয়ামীলীগও তো ৫ বছর ক্ষমতায় ছিলো। তারা কি দেশে ধর্মীয় সৌহার্দ বজায় রাখতে কোন সমস্যা পড়েছিলো? কিছুতেই নয়। তাহলে ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ সংবিধানে ফিরিয়ে আনার পেছনে নিশ্চয়ই অনেক উদ্দেশ্য লুক্কায়িত। যা বুঝতে দৃষ্টি ফেরাতে হবে কামাল আতাতুর্কের তুরস্ক এবং এক সময়ের ইরাক, মিসর ও সিরিয়ার দিকে।

তাছাড়া বিচারপতি খায়রুল হক স্বপ্রণোদিত হয়ে একটি সিনেমা হল সংক্রান্ত মামলায় যে রায় দিয়েছিলো, তাতে মিডিয়াগুলো যদিও সংবাদ প্রকাশ করেছে, আদালত পঞ্চম সংশোধনী বাতিল করেছে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে বিচারপতি খায়রুল হক (বর্তমান বাংলাদেশের বহু সংকটের জনক ও বহু রক্তপাতের পেছনে নাটের গুরু) পঞ্চম সংশোধনীর অনেক মৌলিক বিষয়ই বাতিল করেনি। বরং শুধুই ‘আল্লাহর উপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস’ এতটুকুকে বাদ দিয়েছে। কারণ ৫ম সংশোধনী দ্বারা ৪র্থ সংশোধনীকে বাতিল করা হয়েছিলো। ৪র্থ সংশোধনীতে তৎকালীন মুজিব সরকার যে মৌলিক বিষয় প্রতিষ্ঠা করেছিলো, তা হলো সকল রাজনৈতিক দলকে বাদ দিয়ে বাকশাল গঠন করা হয়েছিলো এবং সকল পত্রিকা বন্ধ করে সরকারী মালিকানায় চারটি পত্রিকা চালু রাখা হয়েছিলো। জিয়াউর রহমান ৫ম সংশোধনীতে ঐ সব বাতিল করে আবার বহুদলীয় গণতন্ত্র এনেছেন এবং সংবাদপত্রের স্বাধীনতা ফিরিয়ে দিয়েছেন এবং ধর্মনিরপেক্ষতার পরিবর্তে ‘আল্লাহর উপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস’ প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন, কিন্তু আদালত ৫ম সংশোধনী বাতিলকালে শুধু শেষোক্তটি বাতিল করেছেন। তাহলে বুঝাই যাচ্ছে খায়রুল হক সাহেবের ঐ সংশোধনী বাতিলের মূল লক্ষ্যই ছিলো সংবিধান থেকে আল্লাহর উপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাসকে বাদ দিয়ে ধর্মনিরপেক্ষতা প্রতিষ্ঠা করা। আদালত যদি পঞ্চম সংশোধনীর মৌলিক ঐ দুটি বিষয়ও বাতিল করতো, তাহলেই তো বরং বর্তমান শাসক গোষ্ঠীর জন্য সবকিছু নিস্কন্টক হয়ে উঠতো। তাদেরকে আর ৫ই জানুয়ারীর নির্লজ্জ ও প্রহসনের তথাকথিত নির্বাচনের মাধ্যমে বে-আইনীভাবে ক্ষমতা দখলের কলঙ্ক গায়ে লেপন করতে হতো না। তাদের ভাষায় আগুণ সন্ত্রাসের মোকাবেলা করতে হতো না ইত্যাদি ক্ষেত্রে তারা আরো নিরাপদ থাকতো। সর্বোপরি বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর পিতার ‘এক নেতা, এক দেশ’ স্বপ্নের সফল বাস্তবায়ন হতো। এতসব সুবিধা থেকে বঞ্চিত হওয়া সত্ত্বেও শাসক গোষ্ঠী ও তাদের দোসরদের ৫ম সংশোধনীর নির্দিষ্ট অংশ আদালত কর্তৃক বাতিলে উল্লসিত হওয়া ভিন্ন কিছুই প্রমাণ করে।

কেউ হয়তো প্রশ্ন করতে পারে, বাংলাদেশে তো আর ইসলামী হুকুমত নেই। সংবধিানেও ইসলামের সাথে সাংঘর্ষিক অনেক বিষয় রয়েছে, তাহলে শুধু ‘আল্লাহর উপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস’ সংবিধানে থাকা আর না থাকাতে কি লাভ বা ক্ষতি? আসলে অনেক বিষয় রয়েছে যেগুলোর জবাব নিজেই খুঁজে পাওয়া যায়, কেউ জবাব দিতে হয় না। এ বিষয়টিও এমনি একটি বিষয়। দেখুন, সংবিধান থেকে যে পদ্ধতিতে বিষয়টিকে নির্বাসন দেয়া হলো এবং এতে তাদের যে পরিমাণ উল্লাস, তা-ই বলে দেয় এটি সংবিধানে থাকলে লাভ কি, আর নির্বাসিত হলে ক্ষতি কি? কারণ এ জন্য তো সরকারকে সমালোচনা এবং বদনামেরও শিকার হতে হয়েছিলো যদিও আন্দোলনের সুযোগ না থাকায় সেভাবে আন্দোলনের মুখে পড়তে হয়নি। তাছাড়া এটি সংবিধানে থাকলে যদি মুসলমানদের কোন লাভই না থাকে, তাহলে ধর্মনিরপেক্ষদেরও কোন ক্ষতি হওয়ার কথা নয়। তাহলে এতকিছুর পরও এত ঝুঁকি নিয়ে তারা তা নির্বাসিত করলো কেন? এর মধ্যেই এ প্রশ্নের উত্তর নিহিত রয়েছে এবং এটি সংবিধানে থাকারও কিছুটা মূল্য রয়েছে।